ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার ব্যাখ্যা



লেখকঃ শামসুর রাহমান



জন্ম: ২৩ অক্টোবর, ১৯২৯ ঢাকায়

মৃত্যু: ১৭ আগস্ট, ২০০৬

পৈতৃক নিবাস: নরসিংদী জেলার পাড়াতলি গ্রাম

পিতা: মুখলেসুর রহমান চৌধুরী

মাতা: আমেনা খাতুন

আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা
শহিদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ,স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং। প্রতি বছরের মতো ১৯৬৯-এ ও শহরের পথে পথে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটেছে। কবির মনে হয় ১৯৫২-এর ভাষা শহিদদের রক্তের বুদবুদ কৃষ্ণচূড়া ফুল হয়ে ফুটেছে। রক্তের রঙ আর কৃষ্ণচূড়ার রঙ একই হওয়ায় একুশের কৃষ্ণচূড়াকে কবি আমাদের চেতনার রঙের সাথে মেলাতে চান। ভাষার জন্য যাঁরা লাল রক্ত দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের ত্যাগের মহিমা যেন মূর্ত হয়ে ওঠে লাল কৃষ্ণচূড়ার রঙে। ফেব্রুয়ারিতেই কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে।

এ রঙের বিপরীতে আছে অন্য রং, লাল রঙের বিপরীত যে রঙ তা অশুভ-সন্ত্রাস, খুনের রং।

যে-রং লাগে না ভাল চোখে, যে রং সন্ত্রাস আনে

প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে সকাল-সন্ধ্যায়

এখন সে রঙে ছেয়ে গেছে পথ-ঘাট, সারা দেশ

ঘাতকের অশুভ আস্তানা। পাকিস্তানী বাহিনীর অশুভ পদচারণা বোঝাতে ব্যবহৃত।

আমি আর আমার মতোই বহু লোক

রাত্রি-দিন ভূলুণ্ঠিত ঘাতকের আস্তানায় কেউ মরা, আধমরা কেউ,

কেউ বা ভীষণ জেদি, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া। চতুর্দিকে

মানবিক বাগান, মনুষ্যত্ব, ন্যায় ও মঙ্গলের জগৎ।
কমলবন পদ্মবাগান, মানবিকতা, সুন্দর ও কল্যাণের জগৎ বোঝাতে ব্যবহৃত।
হচ্ছে তছনছ।

বুঝি তাই উনিশশো উনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
যেহেতু ’৬৯-এর মানবিক বাগান আবার তছনছ হচ্ছে তাই সালাম-বরকতের প্রতিবাদী সত্তা তরুণদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

সালামের চোখে আজ আলোচিত ঢাকা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়কালকে বোঝাতে কথাগুলো উচ্চারিত। কারণ বায়ান্নর আন্দোলনের পথই ঊনসত্তরে এসে আরো বিস্তৃত হয়।

দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই

জনসাধারণ

দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিনাশী বর্ণমালা
ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী স্মৃতি স্মরণ করা হচ্ছে।

আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে

এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
বাঙ্গালীর বেঁচে থাকার ও দাবি-দাওয়ার স্বাভাবিক পরিবেশের অভাবের কথা ব্যক্ত হয়েছে এখানে।

হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায়। সবুজ পূর্ব বাংলা বোঝাচ্ছে।
সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ, প্রাণ ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। তেমনি বাংলা ভাষা ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। এখানে ‘ফুল’ বলতে বাংলা ভাষা বোঝানো হচ্ছে।

শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায় ।



ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদী আন্দোলন। এখানে তিনি স্বাধিনতাকামী মানুষের চেতনাবোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সাধারণ জনতা এই প্রতিবাদের হাতিয়ার। এ কবিতায় জিবনের তাৎপর্যের দার্শনিকতার উন্মোচন ঘটেছে। ১৯৬৯-এর পাকিস্তানি শাসকদের নির্মম অত্যাচার, স্বৈরতান্রিক মনোভাব, অমানবিক নিষ্ঠুরতায় পূর্ববাংলায় মাওনবিকতার ধ্বংসযজ্ঞ কবিতাটিতে বর্ণিত। ১৯৫২ সালে ফাল্গুন/ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এদেশে। ভাষা আন্দলনে অনেক তাজা প্রাণ ঝড়ে গিয়েছিল।, ফাল্গুন মাসে প্রস্ফুটিত ফুল যেন শহিদদের সেই রক্ত ধারণ করে লাল হয়েছে । তাই পথের ধারে থরে থরে লাল কৃষ্ণচূড়া দ্বারা বায়ান্নর ভাষাশহিদদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ৫২’র পরে বাঙালি আরো কিছু বিপ্লব ও সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। যা ঊনসত্তরে এসে আরো বিস্তৃত হয়। তাই ‘সালামের মুখে আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।‘ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন ও অত্যাচার চালায়। চারদিকে হত্যা, সন্ত্রাস, লুন্ঠন জনজীবনে আতঙ্ক তৈরি করে। সারাদেশ অশুভ আস্তানায় পরিণত হয়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের কথা ঊনসত্তরে এসে বাঙালিকে প্রেরণা দেয়। বাংলা ভাষারূপ ফুল ফোটে এই ভয়াল বাস্তবতায়। “সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ”-পঙতিটিতে সেই ফুল বলতে বাংলা ভাষাকে নির্দেশ করা হয়েছে- যা প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রাণের প্রিয়।

কন্টেন্ট ক্রেডিট: হারুন স্যার
সরকারী বিজ্ঞান কলেজ


  • Model Test
    Teachers Content
  • Model Test
    Journalism Course
  • Model Test
    Class 8
  • Model Test
    Class 5
  • Model Test
    Admission